(Translated by https://www.hiragana.jp/)

বিশৃঙ্খলায় রাজধানীর সড়কে যানজট

প্রকাশিতঃ 2:00 pm | October 19, 2024

রাইসুল ইসলাম খান, কালের আলো:

কোনভাবেই শৃঙ্খলা ফিরছে না রাজধানীর সড়কে। যানজট নিরসনে প্রতিদিনই মামলা, জরিমানা, ডাম্পিং চললেও নগরীতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে ডিএমপি’র ট্রাফিক বিভাগ ও বিআরটিএ। তিনহাজার অবৈধ বাসের পাশাপাশি নগরীতে প্রতিনিয়ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান ও থ্রি-হুইলার। নিত্য যানজট তৈরি করছে অসহনীয় দুর্ভোগের। এমনকি যানবাহনের গতিও ৪.৮ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। পরিস্থিতি উত্তরণে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) আজ ১৯ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর ‘ট্রাফিক পক্ষ’ পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। সড়কে অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট ৫ কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করছে।

বিশেষ করে ৫ বছরে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) একটিও সভা হয়নি। এতে বাসমালিকদের জন্য রুটে নতুন বাসের নিবন্ধন কার্যক্রম পুরোপুরি থমকে আছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এম এ বাতেন। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে গত বুধবার (১৬ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সড়ক ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল হাফিজ (অব.) এতে সভাপতিত্ব করেন। সভায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা, দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা এবং বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সোনারগাঁও সার্ক ফোয়ারা ইন্টারসেকশন, ফার্মগেট ইন্টারসেকশন এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের শেরাটন ও বাংলামোটর ইন্টারসেকশনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বুয়েটের সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

রাজধানীর সড়কে যানজটের অন্যতম বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা, ভ্যান ও থ্রি-হুইলারের দাপট। সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, শাহবাগ, কাকরাইল, মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা, এয়ারপোর্ট রোডসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সড়কে বাধাহীনভাবে চলছে অটোরিকশা। গতকাল শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকা থেকে বেশ কয়েকটি অটোরিকশাকে মহাখালী অভিমুখে যেতে দেখা যায়। মূল সড়কে চলার নিয়ম না থাকলেও যাত্রীদের অনুরোধেই চালকরা বাধ্য হচ্ছেন।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ জানায়, রাজধানীতে অটোরিকশা বা অটোভ্যান চার্জ করার জন্য ছোট-বড় কয়েক হাজারের অধিক গ্যারেজে চার্জিং স্টেশন রয়েছে। ২০২১ সালে করা ট্রাফিক পুলিশের একটি তালিকায় ৭৫২ স্টেশনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে ট্রাফিকের ওয়ারী, তেজগাঁও, মতিঝিল, লালবাগ, গুলশান ও উত্তরা বিভাগে সবচেয়ে বেশি চার্জিং স্টেশন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ প্রশাসন এসব দেখেও কোনো জোরদার ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

গত বুধবার (১৬ অক্টোবর) বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত সাড়ে পাঁচ বছরের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রাজধানীর সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে তারা জানায়, গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে ১ হাজার ২২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬১ জন নিহত এবং ১ হাজার ৪৬৩ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা-অটোভ্যান-সিএনজি-লেগুনা-মিশুক চাপায় নিহতের হার ১১ দশমিক ১১ শতাংশ।

এ বিষয়ে যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, অসংখ্য অবৈধ চার্জিং পয়েন্ট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শহরের আনাচে-কানাচে। মানুষের বাসাবাড়িতেও চার্জ করা হয়। অন্তত ছয়-সাত লাখ রিকশা ঢাকার নানা সড়কে রয়েছে। অটোরিকশাগুলো রাতে ১০-১২ ঘণ্টা চার্জে রাখা হয়। অনেকে দিনেও চার্জ করেন। এসব রিকশা চার্জ দিতে গিয়ে দিনে অন্তত ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অপচয় করা হচ্ছে।

অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার অবাধ চলাচল বন্ধের বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নাজমুল হাসান বলেন, ‘রিকশা প্রধান সড়কে চলতে পারবে কি পারবে না, সেটির সিদ্ধান্ত সিটি করপোরেশনের। প্যাডেলচালিত রিকশা নাকি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলবে, তার সব নিবন্ধন দেয় সিটি করপোরেশন। এটি ট্রাফিক বিভাগের কাজ না। দুই সিটি করপোরেশন যদি আমাদের নির্দেশনা দেয় যে রাজধানীতে কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা, গ্যারেজ, চার্জিং স্টেশন কিছু থাকবে না তাহলে আমরা সেভাবে কাজ করব।’

গত ক’দিন সরেজমিনে রাজধানীর বনানী, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, বাড্ডা, রামপুরা, বাংলামোটর, মগবাজার ও কাকরাইলসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ঘুরে দেখা যায়, অনেক যানবাহন সিগন্যাল অমান্য করে চলাচল করছে। প্রবেশমুখগুলো বন্ধ করে অনিয়ন্ত্রিতভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিকশা ও ছোট যানবাহনগুলো। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে বাসগুলো। বিভিন্ন সড়কে বাস-ট্রাক-প্রাইভেটকার পার্ক করে রাখা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে চলছে খোঁড়াখুঁড়িও।

উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ৫৯টি যাত্রী ছাউনিসহ বাস স্টপ চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় স্টপেজে বাস না থেমে যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা করে। মঙ্গলবার দুপুরে রামপুরা ব্রিজ এলাকায় দেখা যায়, ভিক্টর পরিবহণের দুটি বাস যাত্রী তোলার জন্য নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি করছে। কুড়িলে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বলাকা পরিবহণের একটি বাসের চালককে এক হাতে মোবাইল ফোন কানে ধরে কথা বলতে এবং অন্য হাতে স্টিয়ারিং সামলিয়ে গাড়ি চালাতে দেখা গেছে।

যাত্রবাড়ী থেকে টঙ্গী রোডে চলাচলকারী গ্রেট তুরাগ বাসের চালক আব্দুর রহমান বলেন, যাত্রী যেখানে থাকে সেখানেই আমরা বাস থামাই। ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকের হেলমেট থাকলেও আরোহীর মাথায় হেলমেট নেই। অনেক মোটরসাইকেল চালক হেলমেটের ভেতরে মোবাইল ফোন গুঁজে কথা বলতে বলতে পথ চলছেন।

ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, যেখানে-সেখানে পার্কিং, ট্রাফিক সিগন্যাল না মানা, লেন না মেনে এলোমেলো গাড়ি চালানো, পারমিটবিহীন গাড়ি, গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে ব্যাটারি রিকশার দাপট, এমনকি ট্রাফিক পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। একাধিক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য জানান, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তাদের ডিউটি করতে হচ্ছে। অনেকেই নানাভাবে সুযোগ নিয়ে নিয়ম ভাঙছে। মোড়ে মোড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের আক্রমণের শিকারও হচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, এখন আগের মতো আইন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না সড়কে। পারমিট আছে কিনা, চেক করতে গেলে চালকরা নানা বাহানা করছেন। আবার বেশি কিছু বললে ট্রাফিক সদস্যদের ওপর তেড়ে আসছেন।

এসব বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নাজমুল হাসান বলেন, ‘ট্রাফিক বিভাগ সড়ক থেকে অবৈধ যানবাহন সরিয়ে দিতে তার কাজ যথাযথভাবেই করছে। আমরা নিয়মিত অবৈধ যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছি। রাজধানীতে ১০৩টি পয়েন্টে আমরা যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছি। আমরা আজ ১৯ অক্টোবর থেকে ১৫ দিনব্যাপী ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করব।’

কালের আলো/আরআই/এমকে